বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৪৯ অপরাহ্ন
জালাল ফিরোজ :
গ্রন্থমেলা ১৯৮৪ : নাম পরিবর্তন, ‘বাংলা একাডেমী বইমেলা’ থেকে ‘বাংলা একাডেমী অমর একুশে বইমেলা’
১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার নাম পরিবর্তিত হয়। ‘বাংলা একাডেমী গ্রন্থমেলা’-র নাম হয় ‘বাংলা একাডেমী অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। কোন পটভূমিতে এবং কেন নাম পরিবর্তিত হলো এবং এর গ্রহণযোগ্যতা কেমন হয়েছে এসব বিষয়ে নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে। পরিবর্তিত নামে অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের গ্রন্থমেলা অন্যান্য বারের তুলনায় অধিকতর সংগঠিত ও সুশৃংখল ছিল। ৭ই ফেব্রুয়ারি বিকেল পৌনে ৫টায় মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শুরু হয়। মেলার উদ্বোধক ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ ইব্রাহীম। বিশেষ অতিথি ছিলেন মাসিক আল ইসলাহ পত্রিকার সম্পাদক ও ‘সিলেট মুসলিম সাহিত্য সংসদ’-এর প্রবীণ সংগঠক মুহম্মদ নুরুল হক। স্বাগত ভাষণ দেন গ্রন্থমেলা পরিচালনা কমিটির আহ্বায়ক ও একাডেমির বিক্রয় ও বিপণন উপবিভাগের উপপরিচালক হাবীব-উল-আলম। পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর মোহাম্মদ আদেল। সভাপতিত্ব করেন একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা।
এই বছর মেলায় নতুন অনেক বিষয় প্রবর্তিত হয়। নতুন প্রবর্তিত বিষয়গুলোর কিছু পরবর্তীকালে গ্রন্থমেলায় স্থায়ীভাবে গৃহীত হয়। এই বছর মেলা পরিচালনার জন্য একাডেমির কার্যনির্বাহী পরিষদ ৮ সদস্যের একটি ‘পরিচালনা কমিটি’ গঠন করে। স্টল নির্মাণের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকে টিনের ব্যবস্থা করা হয়। মেলার প্রচারের জন্য চারটি জাটিয় দৈনিকে বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহকে কেবল বাংলাদেশে প্রকাশিত বই বিক্রির অনুমতি দেওয়া হয়। তবে বিদেশী বই ‘শুধুমাত্র প্রদর্শনীর জন্য বিক্রয়ের জন্য নয়’ এই শর্তে প্রদর্শনীর সুযোগ দেওয়া হয়। এবারই প্রথম লটারির মাধ্যমে স্টল বরাদ্দের নিয়ম করা হয়। যাদের কমপক্ষে পাঁচটি বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা রয়েছে শুধু তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়। এবারের মেলায় একটি নতুন সংযোজন ছিল ‘তথ্যকেন্দ্র’। মেলা সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ, তথ্য প্রদান ও তথ্য প্রচারের জন্য এই তথ্যকেন্দ্র খোলা হয়। এখান থেকে নতুন বইয়ের খবর সারাক্ষণ প্রচারিত হতো। মাঝে মাঝে যন্ত্রসঙ্গীত ও একাডেমির অনুষ্ঠানের ক্যাসেট বাজানো হতো। ‘আজকের বই’ নামে মেলা প্রাঙ্গণে একাধিক বোর্ড স্থাপিত হয়। এসব বোর্ডে যেদিন যে বই প্রকাশিত হতো সেদিন সেই বইয়ের প্রচ্ছদ ও তথ্যাদি প্রদর্শিত হতো। লেখকদের আড্ডার জন্য ‘বিনোদন কেন্দ্র’ ছিল। একাডেমি মেলা উপলক্ষে দুইটি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছিল। একটির শিরোনাম ছিল ‘বিশেষ প্রদর্শনী’ এবং অন্যটি ছিল ‘বিজ্ঞান প্রদর্শনী’।১
এই মেলা উপলক্ষে বাংলা একাডেমির আয়োজনে বিশেষ প্রতিকৃত প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ছিল। এতে ১১ জন প্রখ্যাত সাহিত্যিকের প্রতিকৃতি প্রদর্শিত হয়। গ্রন্থমেলার ইতিহাসে ১৯৮৪ সালে প্রথম ‘লেখকদের জন্য’ নাম দিয়ে লেখকদের বসার ব্যবস্থা করা হয়। এই ‘লেখকদের জন্য’-ই পরের বছর থেকে ‘লেখক আড্ডা’ বা ‘লেখক কুঞ্জ’ নামে পরিচিত হয়। এই বছর মেলা চলে ৭ থেকে ২৯শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। মেলায় মোট ৮০টি স্টল ছিল। ১৯৮৪ সালে আয়োজিত প্রদর্শনী সম্পর্কে দৈনিক সংবাদ-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় : ‘এবারের মেলার অন্যতম আকর্ষণ বিশেষ প্রদর্শনী। এতে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তৈলচিত্র ও ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিভিন্ন সময়ের ছবি স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে বাংলা বর্ণগুলোর ও সংখ্যাগুলোর ক্রমবিবর্তন দেখানো হয়েছে দু’টি বোর্ডে। এছাড়া এবারের মেলায় ‘রাশিফল’ নামক ব্যতিক্রমী একটি স্টল খোলা হয়েছে।’২ সেই বছরের বইমেলা বর্তমানের মতো ‘কেবল বইয়ের মেলা’ ছিল না। বইয়ের সঙ্গে নাটকের, আবৃত্তির ক্যাসেট, শিল্পীদের আঁকা ছবিও বিক্রির ব্যবস্থা ছিল। ‘বই মেলায় নাটক ও আবৃত্তির ক্যাসেট’ শীর্ষক একটি পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় :
বাংলা একাডেমীর বই মেলায় থিয়েটার নাট্যগোষ্ঠীর স্টলে জনপ্রিয় নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘দুই বোন’ এবং ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়ের আবৃত্তি ‘প্রাণে বাজায় বাঁশি’র ক্যাসেট পাওয়া যাচ্ছে। প্রাণে বাজায় বাঁশিতে রয়েছে মধুসূধন থেকে আবুল হাসান পর্যন্ত বাংলা কবিতার প্রতিনিধিত্বশীল সংগ্রহ।
শিল্পকলা একাডেমীর স্টলে কামরুল হাসানসহ বিশিষ্ট শিল্পীদের আঁকা ছবির প্রিন্ট বিক্রি হচ্ছে প্রতিটি মাত্র ১০ টাকা দামে। ৩
একুশে উদযাপন ও বইমেলাকে কেন্দ্র করে একাডেমি প্রতিদিন আলোচনা সভার ব্যবস্থা করেছিল। ৮ থেকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন মূল মঞ্চে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বইয়ের ওপর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ১৫ থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবন্ধ পাঠ এবং পঠিত প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠান হয়। এই বছর ২১শে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে অনেক দর্শক শ্রোতার সমাগম ঘটে। এই দিনের দর্শক উপস্থিতি সম্পর্কে একাডেমির প্রতিবেদনে উল্লেখ বলা হয় : ‘বাংলা একাডেমীর আর কোন অনুষ্ঠানে কোন দিনই এত বড় জনসমাবেশ হয়নি।’৪ প্রতিদিন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। দেশের প্রখ্যাত শিল্পীরা এসব অনুষ্ঠানে অংশ নেন। ১৯৮৪ সালের বইমেলায় বাংলা একাডেমি মোট ১,৭০,৩৯৪.২৪ (এক লাখ সত্তর তিন শত চুরানব্বই টাকা চব্বিশ পয়সা) টাকার বই বিক্রি করে।
বাংলা একাডেমির অমর একুশে বইমেলা যে পরবর্তীকালে দেশের মানুষের কাছে মুক্তচিন্তা ও প্রগতিশীলতা চর্চার অন্যতম গুরত্বপূর্ণ স্থানে পরিণত হয় তার আভাস ১৯৮৪ সালেই পাওয়া যায়। বইমেলাকে শুরু থেকেই একটি সংবেদনশীল স্থান হিসেবে সাধারণ মানুষ গণ্য করেছে। এই বছর ‘রাশিফল’ নামক যে স্টলটিকে ‘ব্যতিক্রমী ঘটনা’ বলে উল্লেখ করা হয়েছিলো সেই ধরনের স্টল বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানে আদৌ গ্রহণ করা যায় কি না এই প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। সংবাদ-এ প্রকাশিত ‘বাংলা একাডেমীর বইমেলা প্রসঙ্গে’ শীর্ষক একটি পত্রে জামালপুরের বরুয়াজানী থেকে ফজলুল করিম নামের একজন পাঠক উল্লেখ করেন :
মহান ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণে একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে বাংলা একাডেমীর অনুষ্ঠানমালার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। অতীতে সপ্তাহ ব্যাপী আলোচনা সভা, পুস্তক প্রদর্শনী, কবিতা পাঠ, সঙ্গীতানুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলা একাডেমী তাদের অনুষ্ঠান মালা সূচনা করেছেন। এ বছর উপরোক্ত অনুষ্ঠান মালার পাশাপাশি প্রথম বারের মত বাংলা একাডেমী একটি বিশেষ প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেছে। এ বারকার প্রদর্শনীতে একদিকে বাংলা সাহিত্যের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তৈলচিত্র ও ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বিভিন্ন সময়ের ছবি স্থান পেয়েছে। অন্যদিকে দুটি বোর্ডে বাংলা বর্ণ ও সংখ্যাগুলোর ক্রমবিবর্তন দেখানো হয়েছে। বাংলা একাডেমীর এধরনের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই।
কিন্তু ৮/২/৮৪ তারিখে ‘সংবাদ’ পাঠে জানতে পারলাম, ‘রাশিফল’ মানেও একটি ‘ব্যতিক্রম ধর্মী ষ্টল’ মেলায় খোলা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে রাশি ফলের কি সুত্র সম্পর্ক তা আমাদের তা জানা নেই। তবে একুশে ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠানের যে শ্রদ্ধা ও পবিত্রতা রয়েছে, তাতে ‘রাশিফল’ নামক উক্ত ষ্টল খোলাতে তার পবিত্রতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আমাদের বিশ্বাস। এধরনের ষ্টল আনন্দ মেলাতেই শোভা পায়। মহান ঐতিহ্যবাহী কোন জাতীয় অনুষ্ঠানের প্রদর্শনীতে একান্ত বেমানান বলেই আমাদের মনে হয়। কর্তৃপক্ষকে অতি শিগগির ‘রাশিফল’ নামক ব্যতিক্রম ধর্মী ষ্টলটি বন্ধ করে দেয়ার জন্য অনুরোধ করি।৫
পূর্ববর্তী বছরগুলোর তুলনায় ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলা বড় পরিসরে ও অধিকতর সংগঠিত উপায়ে অনুষ্ঠিত হয়। একটি পত্রিকার একুশের ওপর লিখিত প্রতিবেদনে এই বারের বইমেলাকে ‘বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণে স্মরণকালের বৃহত্তম প্রকাশনা মেলা’৬ বলে উল্লেখ করা হয়।
কেন নাম পরিবর্তন
বইমেলা পর্যায়ক্রমে সংগঠিত ও বিস্তৃত হয়েছে। মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। মেলা আয়োজনে নানা মাত্রিকতা যুক্ত হয়েছে। এভাবে বইমেলা ১৯৮৩ পর্যন্ত ‘বাংলা একাডেমী বইমেলা’ নামে শুরু, পরিচিতি লাভ এবং জনপ্রিয়তাও অর্জন করে। ১৯৮৪ সালে এসে মেলার নামে পরিবর্তন আনা হয়। মেলার নাম ‘বাংলা একাডেমী বইমেলা’ থেকে পরিবর্তন করে ‘বাংলা একাডেমী অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ করা হয়। এই পরিবর্তনের প্রয়োজন হলো কেন এবং পরিবর্তনের ফলে মেলার আবেদন ও গ্রহণযোগ্যতায় কোনো ইতিবাচকতা যুক্ত হয়েছে কি? পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে বাংলা একাডেমির কোনো প্রকাশনায় কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে অনুমান করা যায়, ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচারী সরকারের পুলিশের গুলিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রহত্যা ঘটনার যে প্রতিক্রিয়া বাংলা একাডেমীর ১৯৮৩ সালের গ্রন্থমেলার ওপর পড়েছিল তা থেকে শিক্ষা নিয়ে গ্রন্থমেলাকে চেতনা ও অর্থের দিক থেকে আরও বৃহত্তর পরিসরে গ্রহণযোগ্য করার প্রয়োজনীয়তা কর্তৃপক্ষ অনুভব করেছিলেন। এছাড়া সামরিক শাসন জারির পর বাংলা একাডেমির স্বায়ত্তশাসন লঙ্ঘিত হয়। একাডেমির ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ আরোপিত হয়। একাডেমি তখন কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের পরমর্শে নয়, সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশ কর্তৃক পরিচালিত হচ্ছিলো। লেখক-বুদ্ধিজীবীরা এসবের সমালোচনা করেন। একাডেমির সেই সময়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে রাজনৈতিক দলগুলোও অবহিত ছিলো। একাডেমির ওপর সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণ রাজনৈতিক দলগুলো দ্বারা তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। ১৯৮৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি সেই সময়ের ১৫-দলীয় জোটের দেওয়া ‘বাংলা একাডেমীর স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবী’ শীর্ষক বিবৃতিতে বলা হয় :
সামরিক আইন জারির পর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের নির্দেশে বাংলা একাডেমীর স্বায়ত্তশাসন হরণ করা হয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় ক্ষমতা একজন আমলার উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। যিনি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ছাড়া আর কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। বাংলা একাডেমীর কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্যদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একাডেমীর নীতিমালা ও কার্যক্রমের ব্যাপারে জনমতের প্রতিফলন ও নিয়ন্ত্রণের যে সুযোগ ছিল তা-ও ওই নির্দেশবলে কেড়ে নেয়া হয়েছে।…বাংলা একাডেমী কোন শাসক মহলের দান নয়। বাংলা একাডেমী এ দেশের জাগ্রত জনতার বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম, মহান ভাষা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামেরই প্রত্যক্ষ ফসল। সে কারণেই এই একাডেমীর প্রতিষ্ঠা তার লক্ষ্যনীতি ও কার্যাধারার সাথে জনগণ, বিশেষ করে এ দেশের সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, লেখক, শিল্পী, গবেষণাকর্মী এবং সাহিত্য ও সংস্কৃতিসেবীদের গভীর আবেগ ও অনুভূতির প্রশ্ন জড়িত।৭
১৯৮৩ বা ১৯৮৪ সালে বইমেলা সম্পর্কে ছাত্রদের বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কোনো বিদ্বেষ ভাব ছিল না। কিন্তু বাংলা একাডেমি সামরিক সরকারের ইঙ্গিতে পরিচালিত হচ্ছে, ছাত্রদের অনেকের মধ্যে এই ভাবনা কাজ করছিল। ফলে তাদের রাগ ও ক্ষোভ ছিল। এজন্য হয়তো গ্রন্থমেলাকে ছাত্রদের কাছে একুশের চেতনার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে আরও আবেদনময় ও ভাষা-আন্দোলন তথা ছাত্র-আন্দোলনের সঙ্গে নিরিড়তর করার পরিকল্পনা ছিল বাংলা একাডেমির। এই যুক্তি সমর্থিত হয় ঐ সময়ের বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মনজুরে মওলা ‘অমর একুশে’ নামের তাৎপর্য সম্পর্কে পরবর্তীকালে যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তার প্রতি দৃষ্টি দিলে। ২০০৫ সালে তিনি বাংলা একাডেমিতে তাঁর কর্মজীবনের স্মৃতিচারণে উল্লেখ করেন :
আজকের এই যে বাংলা একাডেমীর বইয়ের মেলা হয়েছে এটি এক সময় ছিল বাংলা একাডেমির বইমেলা। ১৯৮৪ সালে এটা হয়ে যায় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। পরিবর্তনটা কেবল নামের নয়। বাংলা একাডেমীর বইমেলা মানে বাংলা একাডেমীর না [বা] কোনো একটি সংস্থার বইমেলা। অমর একুশে গ্রন্থমেলা মানে সারাদেশের মানুষের গ্রন্থমেলা। অমর একুশের সাথে যার সম্পর্ক কখনো ছিন্ন করা যাবে না। আজ এই বিশাল বইমেলা দেখে আমরা সবাই খুব আনন্দিত হই।৮
এটা ঠিক যে, বাংলা একাডেমির গ্রন্থমেলার নামে সঙ্গে ‘অমর একুশে’ যুক্ত হওয়ায় এর সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলা একাডেমি একুশের আন্দোলন থেকে জাত একটি প্রতিষ্ঠান। আর এই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা আয়োজিত বইমেলার নাম ‘অমর একুশে বইমেলা’ হবে এটাই স্বাভাবিক। সারাদেশের মানুষের কাছে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামটি যেভাবে গৃহীত হয়েছে তাতে প্রমাণিত হয় বাংলা একাডেমির এই সিদ্ধান্ত সময়োচিত এবং জন-আকাঙ্ক্ষার অনুকূল ছিল।